
সোমবার ০৫ মে ২০২৫
কৌশিক সরকার
ডেপুটি ডিরেক্টর
টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ
বর্তমানে এদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ কোটি স্কুলপড়ুয়া ও কলেজ শিক্ষার্থী। এর প্রেক্ষিতে, জাতীয় শিক্ষানীতির সফল প্রয়োগ এত বড় মাপের একটা প্রয়াস, যা বিশ্বে এর আগে কোথাও কখনওই হয়নি। এবার এক এক করে বোঝার চেষ্টা করব, এর সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী এবং খামতি কোথায়।
প্রথমত, ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রের বিশাল আকার ও বৈচিত্র। দেশের শুধু স্কুলশিক্ষার পরিসরটাই দেখুন। স্কুলের সংখ্যা ১৫ লক্ষের বেশি, ২৫ কোটিরও বেশি পড়ুয়া, ৮৯ লক্ষ শিক্ষক নিয়ে আমাদের দেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিক্ষাক্ষেত্র। উচ্চশিক্ষার পরিসরটাও দেখুন। এআইএসএইচই ২০২১ রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্র গঠিত হয়েছে প্রায় ৪.১৪ কোটি ছাত্রছাত্রী, ১৫.৫ লক্ষ শিক্ষক, ১১১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৩৭৯৬টি কলেজ এবং ১১২৯৬টি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে। সমস্ত রাজ্য, জেলা, মহকুমা ও ব্লকস্তরীয় সকল স্বার্থধারককে একযোগে নিয়ে সারা দেশ জুড়ে একটাই শিক্ষানীতি চালু করা কতটা দুরুহ কাজ, বোঝা কঠিন নয়।
দ্বিতীয়ত, জাতীয় শিক্ষানীতির সফল প্রয়োগ অনেকটাই রাজ্যের ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। কে কস্তুরীরঙ্গনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া কমিটি সঠিকভাবেই উল্লেখ করেছেন, ভারতের শিক্ষানীতি বরাবরই তহবিলের অভাবে ভোগা, আমলাতান্ত্রিক এবং এতে উদ্ভাবনী ক্ষমতার অভাবগ্রস্ত। কেন্দ্র ও রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রকের পাশাপাশি অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি শিক্ষাক্ষেত্রে এত বড় মাপের রূপান্তর পরিচালনায় অপর্যাপ্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিষয়বস্তু ভিত্তিক ও মুখস্থসর্বস্ব অনমনীয় শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার পথে সরে আসার জন্য সবার আগে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনাকারী ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রয়োজন, শিক্ষক, পড়ুয়া ও অভিভাবকদের কথা তো ছেড়েই দিন।
তৃতীয়ত, জাতীয় শিক্ষানীতিতে কিছু অযৌক্তিক লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ১১১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও (জিইআর) প্রায় দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়েছে (বর্তমানে জিইআর হল ২৭.৫), যার অর্থ হল আগামী ১৫ বছরে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটি করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হবে। এছাড়া বর্তমানে স্কুলে যায় না, এমন ২ কোটি পড়ুয়াকে স্কুলশিক্ষার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। আগামী ১৫ বছরে এই লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে প্রতি সপ্তাহে ৫০টি করে নতুন স্কুল খুলতে হবে। সেক্ষেত্রে আবার প্রতি সপ্তাহে ৫০ জন করে প্রধান শিক্ষক এবং ২০০ থেকে ৩০০ জন করে শিক্ষক নিয়োগ করে চলতে হবে। চালু স্কুলগুলিই যেখানে শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে, সেখানে এগুলোর কোনওটাই বাস্তবে সম্ভব?
চতুর্থত, কেন্দ্র–রাজ্য সহযোগিতা। কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি করলেও এর প্রয়োগের সিংহভাগই
রাজ্যগুলির সক্রিয় সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। জাতীয় শিক্ষানীতির বেশ কয়েকটি সংস্থান ও এটি প্রচলনের পদ্ধতি নিয়ে বেশ কয়েকটি রাজ্য ইতিমধ্যেই আপত্তি জানিয়েছে। তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক যেমন জানিয়ে দিয়েছে, তারা জাতীয় শিক্ষানীতি মানছে না। পশ্চিমবঙ্গও যেমন চার বছরের ডিগ্রি কোর্স মেনে নিলেও নিজস্ব ৫+৪+২+২ ধাঁচের স্কুলশিক্ষা কাঠামো (জাতীয় শিক্ষানীতি ৫+৩+৩+৪ ধাঁচের) অনুসরণ করবে বলে জানিয়েছে। কেরালাও ৫+৩+৩+৪ কাঠামো তো মানেইনি, উপরন্তু প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ন্যূনতম বয়স পাঁচই (জাতীয় শিক্ষানীতিতে ছয় করার কথা বলা হয়েছে) রেখেছে। পাশাপাশি, এনসিইআরটি পাঠ্যসূচি থেকে মহাত্মা গান্ধীর হত্যা ও মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস অধ্যায়গুলি বাদ দিলেও কেরালা সরকার ১০+২ স্তরের পড়ুয়াদের জন্য আলাদা একটা সম্পূরক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছে যেখানে এগুলি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
পঞ্চমত, বেসরকারি ক্ষেত্রের ভূমিকা, বিশেষত উচ্চশিক্ষায়। বর্তমানে এদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ৭০ শতাংশই (কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়) বেসরকারি এবং এগুলিতে প্রায় ৬৫–৭০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তাছাড়া, উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রের আর্থিক ও উদ্ভাবনী অবদানও অনস্বীকার্য। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে জাতীয় শিক্ষানীতির সফল রূপায়ণে অংশীদার করার ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকার ও নিয়ন্ত্রক সত্তাগুলির সদর্থক ভূমিকা জরুরি।
ষষ্ঠত, ‘পরিবর্তনে বাধা’ দেওয়ার মানসিকতা। নতুন শিক্ষানীতিতে গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার বদলে যে বহুমুখী চিন্তাধারা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, তা শিক্ষক, পড়ুয়া ও অভিভাবকদের থেকেও বাধার মুখে পড়ছে, যাঁরা মূলত শিক্ষাদান ও শেখার ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ অনুযায়ী উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে ‘ইন্টার–ডিসিপ্লিনারি লার্নিং’–এর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা বর্তমানে দেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসা শিক্ষাপদ্ধতির থেকে অনেকটাই আলাদা। নতুন শিক্ষানীতির সফল প্রয়োগ করতে গেলে আগামিদিনে দেশের সম্পূর্ণ উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে বড় মাপের মানসিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসতে হবে।
সপ্তমত, নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানে বিশাল সংখ্যক প্রশিক্ষিত শিক্ষকের একটা দল গড়ে তোলা। এখানেও বিরাট খামতি থেকে গেছে।
একেবারে শেষে লিখলেও এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় সমস্যা।
জাতীয় শিক্ষানীতির নথি অনুযায়ী, এর সফল রূপায়ণের জন্য দেশের জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশের সমতুল আর্থিক সংস্থান প্রয়োজন। অথচ তথ্য বলছে, ১৯৬৮ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা হলেও এতগুলো দশকে কখনওই তা ৩ শতাংশও ছাড়ায়নি (২০২৩–এর বাজেটে এর সংস্থান মাত্র ২.৯%)। আজ পর্যন্ত সরকারের কোনও সুস্পষ্ট রোডম্যাপ নেই যে, কীভাবে এত বিপুল পরিমাণ আর্থিক সংস্থান করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, ভারত যদি দ্রুত উন্নয়নশীল জ্ঞানের অর্থনীতির সুবিধাগুলি কাজে লাগাতে চায়, সেক্ষেত্রে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির কার্যকরী বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এর সফল প্রয়োগের প্রায় পুরোটাই নির্ভর করবে কেন্দ্রের মানসিকতা এবং সংস্কারে রাজ্যগুলি কীভাবে অংশ নিচ্ছে, তার ওপর। এর কারণ হল বেশিরভাগ পরিষেবা সম্পর্কিত শিক্ষাই রাজ্য সরকারগুলি দ্বারা সঞ্চালিত হয়। সংক্ষেপে, মূল উদ্যোগগুলি চালুর ক্ষেত্রে কেন্দ্রকে যুক্তরাষ্ট্রীয় সমবায় এবং বিকেন্দ্রীকরণের নীতিগুলি দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে।